শিশুর পেটে কৃমি: কারন ও লক্ষন,ঘরোয়া প্রতিকার | Worm infections in Babies,Kids And Toddlers

By | May 9, 2019

ছোট থেকে বড় মোটামুটি সব বয়সের মানুষ কৃমি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে।তবে শিশুদের কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।কৃমি শরীরে বসবাসকারী একধরনের পরজীবী যা মানুষের শরীর থেকে খাবারের পুষ্টিগুন শোষন করে জীবন ধারন করে।শিশুদের জন্য এটি সবচেয়ে বেশি কস্টের কারন তারা সহজেই তাদের সমস্যার কথা বলতে পারেনা।কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হলে শিশুদের শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানষিক বিকাশও ব্যাহত হয়।
শিশুরা সাধারনত গুঁড়া কৃমি(Thread worms/ pin worms) দ্বারা সবচেয়ে বেশী সংক্রামিত হয়ে থাকে,এছাড়াও গোল কৃমি বা ফিতা কৃমিও ক্ষেত্র বিশেষে শিশুদের শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

শিশুর শরীরে কৃমি সংক্রমণের লক্ষন

  • শিশুর মলদ্বারের চারপাশে চুলকানী
  • ভ্যাজাইনাল এড়িয়াতে (vaginal area) অসস্তি এবং চুলকানী
  • পেটে ব্যাথা
  • মলের সাথে কৃমির উপস্থিতি পাওয়া
  • ডাইরিয়া/ঘন ঘন দুর্গন্ধযুক্ত পাতলা পায়খানা
  • খাবারের প্রতি অনীহা(রুচি কমে যাওয়া),কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হলে ক্ষুধা বেড়ে যায়।
  • আয়রনের ঘাটতি ও রক্তশূন্যতা
  • বমি
  • বদ হজম(গ্যাস,পেট ফুলে থাকা)
  • মাথা ব্যাথা
  • রাতে ভালভাবে ঘুমাতে না পারা
  • অনেক সময়ে বাচ্চারা যথেস্ট পরিমানে খাবার খাওয়ার পরেও ওজন না বাড়া কিংবা ধীরে ধীরে ওজন কমে যাওয়াও কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার লক্ষন প্রকাশ করে থাকে।
কৃমি সংক্রমণের কারন

  • শিশুরা সাধারনত মাটি এবং পানির সংস্পর্শে কৃমি দ্বারা সবচেয়ে বেশি সংক্রামিত হয়ে থাকে।কৃমির ডিম দৈনন্দিন খাবার কিংবা ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।খালি পায়ে সরাসরি মাটিতে হাটলে অনেক সময় কৃমির ডিম চামড়ার মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।
  • এছাড়াও বড়রা (মা,বাবা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা খাবার তৈরী করে বা বাচ্চাকে খাওয়ায়) তারা যদি কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হয়ে থাকে তবে আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড় চোপড় হাত, পা,নখের মাধ্যমে কৃমির ডিম শিশুর পেটে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ছড়ায়।
  • অনেক সময় মাছ ,মাংস কিংবা কাঁচা শাক সবজির মাধ্যমেও কৃমির ডিম শিশুর পেটে প্রবেশ করে থাকে।
কৃমির সংক্রমণ নির্ণয়ে পরিক্ষা

শিশুর শরীরে কৃমির সংক্রমণ ঘটলে সাধারনত তা বাহ্যিক লক্ষন থেকেই বোঝা যায়।এছাড়াও সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তাররা শিশুর মলের নমুনার প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা করে থাকে।এছাড়াও আরও বেশ কিছু পরিক্ষা পদ্ধতি আছে যা ডাক্তাররা পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয়

  • শিশু থেকে শুরু করে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য কে খাবার আগে এবং মল ত্যাগের পর নিয়মিত ব্যাকটেরিয়া বিনাশকারী (anti bacterial) সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • সব শ্রেনীর মানুশের জন্য স্যানিটারী লেট্রিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
  • মা কিংবা যারা শিশুর খাবার তৈরী করে এবং খাওয়া, তাদের নখ অবশ্যই কেটে ছোট রাখতে হবে এবং খাবার তৈরী ও পরিবেশনের আগে হাত বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
  • শিশুকে নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি দিয়ে গোসল করাতে হবে এবং ব্যবহৃত কাপড় চোপড় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  • শিশুকে সরাসরি অপরিস্কার মাটিতে খেলতে বা খালি পায়ে হাটতে দেয়া যাবে না।শিশুর জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
  • নিয়মিত শিশুর নখ কেটে ছোট রাখতে হবে এবং দাঁত দিয়ে নখ কাটার অভ্যাস প্রতিরোধ করতে হবে।
  • বাড়িতে পোষা প্রানী থাকলে তাদের খাবার পাত্র সব সময় পরিস্কার রাখতে হবে এবং অবশ্যই শিশুদের হাতের নাগালের বাহিরে রাখতে হবে।
  • পোষা প্রানীকে নিয়মিত টীকা(vaccine) দিতে হবে কারন এরা কৃমি সহ আরও অনেক রোগের বাহক।
  • মাছ কিংবা মাংস খুব ভালভাবে সেদ্ধ করে শিশুকে খাওয়াতে হবে কারন গ্রহনকৃত মাছ বা প্রানী কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হলে কৃমির ডিম শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।তাই কোন অবস্থাতেই কাঁচা কিংবা অর্ধসিদ্ধ মাছ বা মাংস শিশুকে খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • শাক সবজি কিংবা ফল অবশ্যই ভাল করে ধুয়ে জীবানু মুক্ত করে নিতে হবে।
  • কৃমি সংক্রমণ রোধে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য কে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে।

চিকিৎসা

আমাদের দেশে সাধারনত ২ বছরের বেশি বয়সি শিশুদের Albendazole শ্রেনীর ঔষধ দিয়ে কৃমির চিকিৎসা করা হয়।শিশুদের যেকোন ধরনের ঔষধ খাওয়ানোর আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।

আমাদের অনেকের মধ্যে এখনো এই ভুল ধারনা টা আছে যে চিনি গুড় কিংবা মিষ্টি জাতীয় খাবার শিশুকে খাওয়ালে কৃমি হবে।এটা একেবারে ভুল ধারনা,মিষ্টি খাবারের সাথে কৃমি সংক্রমণের কোন সম্পর্ক নেই।কৃমির সংক্রমণ ঘটে কৃমির ডিম থেকে যা অপরিস্কার অপরিচ্ছন্নতার জন্য হয়ে থাকে।

সাধারনত শিশুর বয়স ২ বছর পূর্ণ হবার পর কৃমির ঔষধ খাওয়ানোর কথা বলা হয়ে থাকে।যদিও পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিশুর বয়স ১ বছর পূর্ণ হবার পর থেকেই চিকিৎসকরা কৃমি রোধ করার ঔষধ ব্যাবহারের নির্দেশনা দিয়ে থাকে।তাই শিশুর বয়স ২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে যদি কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী কৃমির ঔষধ খাওয়াতে হবে।এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাচ্চাদের কৃমির ঔষধ খাওয়ালে চলবে না,পরিবারের সবাইকে একসাথে কৃমির ওষুধ খেতে হবে।এতে করে কৃমির সংক্রমণ একেবারে নস্ট হয়ে যাবে।তবে পরিবারের গর্ভবতী,অসুস্থ(জ্বর কিংবা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত) এবং খুব ছোট শিশু সদস্য কে কৃমির ঔষধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে।

কৃমির সংক্রমণ রোধে ঘরোয়া চিকিৎসা

বেশ কিছু ঘরোয়া উপায়ে কৃমির সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহন করতে হবে।আমাদের দেশে কৃমি মারার জন্য হাজারো রকমের ঘরোয়া টোটকা রয়েছে যার অনেকগুলিই বাচ্চাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।তাই বাচ্চাদের উপরে যেকোন ধরনের ঘরোয়া চিকিৎসা প্রয়োগ করার আগে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।

কাঁচা হলুদের রস

কৃমির সংক্রমণ রোধের জন্য কাঁচা হলুদের রসের সঙ্গে গুড় অথবা মধু মিশিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াতে পারেন।বেশ কয়েকদিন সকালে খালি পেটে এটা বাচ্চাদের খাওয়ালে পেটের ভিতরে কৃমির ডিম থাকলে তা নস্ট হয়ে যায়।তবে হলুদ অথবা মধুতে বাচ্চার অ্যালার্জি আছে কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।

আনারস

আনারসে ব্রোমেলিন নামক একধরনের এনজাইম থাকে যা কৃমির মত পরোজীবি নস্ট করতে সাহায্য করে থাকে।বেশ কয়েকদিন সকালে খালি পেটে বাচ্চাদের আনারস খাওয়ালে কৃমির সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে।তবে যেসকল বাচ্চারা দুধ খায় তাদের আনারস খাওয়ানোর অন্তত ২ ঘন্টা আগে এবং পরে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে ।কারন আনারস এবং দুধ এক সাথে খেলে অনেক সময়ে পেটে বমি,বদ হজম সহ আরও বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এছাড়াও নিম,রসুন,মিষ্টি কুমড়োর বীজ,নারিকেল,জোয়ান,করোল্লা,গাজর এবং অ্যাপল সাইডার ভিনিগার সহ আরও অনেক খাবার আছে যেগুলি কৃমির সংক্রমণ রোধ করে থাকে।তাই কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার আগেই শিশু সহ পুরো পরিবারের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় এসকল খাবার রাখতে হবে এবং সেই সাথে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয় টি নিশ্চিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *